বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক লুটপাটে ছোট আপা !

বেসিক ব্যাংক নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকের বড় অনিয়মের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের মধ্যকার আলোচনায় বারবার এসেছে শেখ রেহানার নাম। যদিও আওয়ামী লীগের দেড় দশকে বিষয়টি প্রকাশ্যে উচ্চারণের সাহস হয়নি কারো। বেসিকের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য চার প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালীর চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রেও সর্বেসর্বা ছিলেন শেখ রেহানা। তার সুপারিশেই এসব ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পদে নিয়োগ দিতেন শেখ হাসিনা। কিছু ক্ষেত্রে ডিএমডি বা জিএম পদে পদোন্নতি পেতেও শেখ রেহানার আশীর্বাদের প্রয়োজন হতো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, শেখ রেহানার পক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় সংঘটিত অনিয়মগুলো ঘটেছে মূলত সালমান এফ রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের তদারকিতে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি হতে এ দুই ব্যক্তির কাছে লবিং করতেন প্রার্থীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজনের সুপারিশেই পদ পাওয়া যেত। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের দুজনেরই সম্মিলিত সম্মতির প্রয়োজন হতো। চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম তারা শেখ রেহানার কাছে পাঠাতেন। শেখ রেহানার সুপারিশের পরই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগ দিতেন শেখ হাসিনা।

এ বিষয়ে জানতে গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক, এমডি, ডিএমডির দায়িত্ব পালনকারী এক ডজনেরও বেশি ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়। নাম অপ্রকাশিত রাখার জোর অনুরোধ জানিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই।

তাদের ভাষ্য হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগের আগে সালমান এফ রহমান বা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ ঘুস দিতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে এ ঘুসের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে বড় ঋণগ্রহীতা বা করপোরেট গ্রুপগুলো পরিশোধ করত। এক্ষেত্রে শর্ত থাকত, চেয়ারম্যান-এমডি হওয়ার পর ওই অর্থ পরিশোধকারী গ্রুপকে ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে বড় অংকের অর্থ তুলে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। পর্ষদে দুই-তিনজন প্রভাবশালী পরিচালক থাকতেন। রাজনৈতিক নেতা বা আওয়ামী পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত এসব পরিচালকের কাজ ছিল পর্ষদকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বড় ঋণের প্রস্তাব পাস করে দিলে তারাও এ ঘুসের একটি অংশ পেতেন। তদবিরের বাইরে নিয়োগ পাওয়া পরিচালকদের দায়িত্ব কেবল পর্ষদ সভার কোরাম পূর্ণ করায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো বিষয়েই সৎ পরিচালকদের দৃঢ় অবস্থান নেয়ার সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে এভাবেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল খেলাপি। তবে সেপ্টেম্বরের পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। খেলাপি হয়ে পড়ার বাইরেও আরো অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। খেলাপি ঋণের প্রভাবে পাঁচ ব্যাংকেরই মূলধন ঘাটতি তীব্র হয়ে উঠেছে। যথাযথ সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখা হলে সবক’টি ব্যাংকই লোকসানে পড়বে।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রায়ত্ত সবক’টি ব্যাংকেই চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডি নিয়োগ দেয়া হয় দলীয় বিবেচনায়। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে কাজী বাহারুল ইসলাম, জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে আবুল বারকাত, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে খন্দকার বজলুল হক, রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে আহমেদ আল-কবীর ও বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেয়া হয়।

ব্যাংকগুলোর পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয় সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী জান্নাত আরা হেনরী, কক্সবাজারের সাইমুম সরওয়ার কমল, সুভাস সিংহ রায়, দৈনিক সংবাদের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ুন, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বলরাম পোদ্দার ও নাগিবুল ইসলাম দীপু, শাহজাদা মহিউদ্দিনের মতো দলীয় ব্যক্তিদের। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সবক’টি ব্যাংকেই দলীয় অনুগত এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া এসব নিয়োগের পরপরই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয়।

২০১৬ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্‌ মাসুদ। ২০১৯ সালে তাকে সোনালী ব্যাংক থেকে সরিয়ে তিন বছরের জন্য রূপালী ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি এখন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

ওই সময়কার নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের এমডি পদে পুনর্নিয়োগ পাওয়ার জন্য ১০০ কোটি টাকা ঘুস দিতে হবে বলে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, ১ টাকাও আমাকে দিতে হবে না। আমার পক্ষে অন্য কেউ এ টাকা পরিশোধ করবে। পরে ওই গ্রুপকে অনৈতিক ছাড় দিতে হবে। কিন্তু এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ভালো পারফরম্যান্সের পরও সোনালী থেকে সরিয়ে আমাকে রূপালী ব্যাংকের এমডি পদে পাঠানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘দুটি ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেছি। কোনো ব্যাংক থেকেই এস আলম বা সালমান এফ রহমানকে কোনো অনৈতিক সুবিধা নিতে দিইনি। এ কারণে তারা আমার ওপর নাখোশ ছিলেন।’

শেখ রেহানার পক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডি নিয়োগে ভূমিকা রাখতে গিয়ে সালমান এফ রহমান নিজেও সুবিধা নিয়েছেন। কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চারটি ব্যাংক থেকে তার বেক্সিমকো গ্রুপ ঋণ নিয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকেই বেক্সিমকোর ঋণের স্থিতি এখন ২৬ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

শেখ রেহানা উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনের একটি বাড়িতে বসবাস করেন। নথিপত্র অনুযায়ী, ওই বাড়িটির মালিক সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান। শেখ হাসিনার পতনের পর অন্যদের সঙ্গে শায়ান রহমানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংক পর্ষদ থেকেও তাকে অপসারণ করা হয়েছে। আর সালমান এফ রহমান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আছেন।

শেখ রেহানার পাশাপাশি প্রভাবশালীদের কাছ থেকে বাড়ি উপহার নেয়ার নানা ঘটনা সামনে আসছে তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকের বিরুদ্ধেও। এর মধ্যে শেখ রেহানা ও তার ছোট মেয়ে আজমিনা হ্যাম্পস্টেডে ৫ লাখ পাউন্ডের আরেকটি ফ্ল্যাটে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করেছিলেন। এটি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফর উল্লাহর মালিকানাধীন।

গত ১৭ ডিসেম্বর ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও শেখ রেহানার বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এর মধ্যে ২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে টিউলিপের মধ্যস্থতার অভিযোগের বিষয়টিও রয়েছে। দুদকের এ ঘোষণার পর দেশে এবং যুক্তরাজ্যেও তদন্তের মুখে পড়েছেন টিউলিপ। যদিও এ অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন টিউলিপ।

এছাড়া যুক্তরাজ্যে তার বিনামূল্যে পাওয়া একাধিক অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। গত ৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালে টিউলিপ কিংস ক্রস এলাকার কাছে একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিনামূল্যে পান। অ্যাপার্টমেন্টটি টিউলিপকে বিনামূল্যে দিয়েছিলেন আবদুল মোতালিফ নামের একজন আবাসন ব্যবসায়ী। তিনিও আওয়ামী লীগ ও টিউলিপের পরিবারের সদস্যদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

টিউলিপ সিদ্দিক বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ট্রেজারি) অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বেও আছেন। যদিও এখন দুর্নীতির অভিযোগে নিজেই মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

২০১২ সালের পর তিন বছর সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন মো. আতাউর রহমান প্রধান। ওই সময় সংঘটিত নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর পরিচালন ব্যর্থতায় বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাজ্যে থাকা বাংলাদেশী ব্যাংকটি। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মালিকানার একমাত্র ব্যাংকটি ডুবে গেলেও পুরস্কৃত হন আতাউর রহমান প্রধান। ২০১৬ সালে তাকে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ দেন শেখ হাসিনা। ওই ব্যাংকে তিন বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৯ সালের আগস্টে তাকে নিয়োগ দেয়া হয় সোনালী ব্যাংকের এমডি পদে। সেখান থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০২৪ সালের ৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি লালমনিরহাট-১ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। প্রথমে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইলেও পরে ডামি প্রার্থী হন তিনি।

আতাউর রহমান প্রধানঘনিষ্ঠ একটি সূত্র সংবাদ মাধ্যমকে জানায়, সোনালী ব্যাংক ইউকের শীর্ষ নির্বাহী থাকা অবস্থায় শেখ রেহানার সঙ্গে সুসম্পর্ক হয় তার। অভিযোগ আছে, ওই সময় বাংলাদেশ থেকে শেখ রেহানাকে টাকা পাচারে সহযোগিতা করেছেন তিনি। ওই সম্পর্কের জেরেই যুক্তরাজ্যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের শাস্তি পেলেও দেশে ফিরে আতাউর রহমান প্রধান পুরস্কৃত হয়েছেন। রূপালী ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালনের পর তাকে সোনালী ব্যাংকের এমডি পদে নিযুক্ত করা হয়।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও আতাউর রহমান প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে আতাউর রহমান প্রধানও পলাতক রয়েছেন। তার ব্যবহৃত সেলফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই সোনালী ব্যাংকের ‘হলমার্ক’ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দেশব্যাপী আলোড়ন দেখা দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছিল গ্রুপটি। হলমার্ক ছাড়াও ব্যাংকটিতে আরো ছোট-বড় অনেক ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে। তবে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ মুহূর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য তিন ব্যাংকের তুলনায় সোনালীর আর্থিক সূচকগুলো কিছুটা ভালো। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশ।

অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে ২৬ হাজার ৮৯২ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটি ৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপনও করেছে। ওই সময় পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণও ছিল ৪ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার বেশি। আর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই এখন খেলাপি। আর সঞ্চিতি (প্রভিশন) ও মূলধন ঘাটতির পরিমাণ আরো নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর জন্য এখন বাজার থেকে অর্থ ধার করছে অগ্রণী ব্যাংক। যদিও আগে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটি থেকে অন্য ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নিত।

এক সময় দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি ছিল জনতার। কিন্তু গত দেড় দশকে সীমাহীন লুণ্ঠনের মাধ্যমে এ ব্যাংকটিকেও শেষ করে দেয়া হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ তথ্যের চেয়েও জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি আরো খারাপ। ব্যাংকটির পর্ষদে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৭৫ শতাংশেরও বেশি এখন খেলাপি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেকোনো সময় ব্যাংকটি সিআরআর-এসএলআর ঘাটতিতে পড়ে যেতে পারে।

জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ৯৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এর অর্ধেকেরও বেশি তথা ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকাই নিয়েছে মাত্র পাঁচটি গ্রুপ বা পরিবার। এর মধ্যে এককভাবে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ নিয়েছে ২৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এছাড়া এস আলম গ্রুপ ১০ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, এননটেক্স গ্রুপ ৭ হাজার ৭৭৪ কোটি, ক্রিসেন্ট গ্রুপ ৩ হাজার ৮০৭ কোটি ও ওরিয়ন গ্রুপ ৩ হাজার ১১ কোটি টাকা নিয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর মতো রূপালী ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতিও ভয়াবহ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত রূপালী ব্যাংক ২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতেও ছিল। সেপ্টেম্বরের পর এ ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের প্রায় ৩০ শতাংশ ঋণই খেলাপির খাতায় চলে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে লুণ্ঠনের শিকার হওয়া বেসিক ব্যাংক এখনো বিপর্যয়ের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। গত ১১ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটির নিট লোকসান হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচানোর জন্য সরকার বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে। বিপুল অংকের এ অর্থ পেয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেসিক ব্যাংক। উল্টো ব্যাংকটি এখনো প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬৫ শতাংশ এখন খেলাপি, যার পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।

ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকগুলো থেকে বের করে নেয়া লাখ কোটি টাকার ১৫-২০ শতাংশ অংশ ঘুস হিসেবে বণ্টিত হয়েছে বলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বেনামি কিছু ঋণের সরাসরি সুবিধাভোগী ছিল শেখ পরিবার। আর আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা যেসব ঋণ নিয়েছেন, সেগুলোরও ১৫-২০ শতাংশ বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুস হিসেবে দিয়েছেন।’

তবে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. শামস-উল-ইসলাম দাবি করেছেন, ‘দায়িত্ব পালনকালে তিনি কোনো অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি। এমডি হওয়ার জন্য কাউকে ঘুসও দিতে হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাধিকবার আমার বিষয়ে তদন্ত করেছে। কিন্তু কোনো অভিযোগেরই সত্যতা পায়নি। আমি এখনো দেশেই আছি। দেশের বাইরে আমার কোনো সম্পদ নেই। জিএম থেকে ডিএমডি হওয়ার সময় আমাকে বিএনপিপন্থী বানিয়ে একবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। আমার শ্বশুর বিএনপির দুইবারের সংসদ সদস্য ছিলেন।’

শামস-উল-ইসলাম ২০১৬ সালের আগস্ট থেকে টানা সাত বছর অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ছিলেন। দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে ঘুসের বিনিময়ে প্রভাবশালী গ্রাহকদের ঋণ পাইয়ে দেয়ার বিস্তর অভিযোগ উঠেছিল। পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও আর্থিক খাতের অলিগার্ক হিসেবে পরিচিত চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের মধ্যস্থতায় শেখ রেহানার আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অগ্রণী ব্যাংকের এমডি থাকা অবস্থায় তিনিই প্রথম ব্যাংকটিতে ‘মুজিব কর্নার’ স্থাপন করেন। পরে শেখ হাসিনাকে অবহিত করার মাধ্যমে তা সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এটি স্থাপনের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।

Sheikh Rehana’s name has repeatedly come up in discussions among those concerned about major irregularities in other state-owned banks, not just Basic Bank. Although no one dared to mention the matter publicly in the decade and a half of the Awami League. Sheikh Rehana was also instrumental in appointing the chairman, director and MD of the other four major state-owned commercial banks like Basic: Sonali, Janata, Agrani and Rupali. Sheikh Hasina would appoint people to policy-making positions in these banks on her recommendation. In some cases, Sheikh Rehana’s blessings were required even to get promoted to the DMD or GM positions, according to those concerned.

They say that the irregularities committed in state-owned banks on behalf of Sheikh Rehana mainly occurred under the supervision of Salman F. Rahman and Chowdhury Nafiz Sarafat. Candidates lobbied these two individuals to become the chairman and MD of the bank. In some cases, the posts were obtained on the recommendation of one of them. In other cases, the joint consent of both of them was required. They would send the names of the final candidates to Sheikh Rehana. Sheikh Hasina used to appoint the chairman-MD of the state-owned bank only after the recommendation of Sheikh Rehana.

To find out about this, more than a dozen people who have served as chairman, director, MD, and DMD of state-owned banks in the last decade and a half were spoken to. Almost all of them strongly requested to remain anonymous.

Their explanation is that before appointing the chairman-MD of the state-owned bank, a large amount of bribe had to be paid through Salman F. Rahman or Chowdhury Nafiz Sarafat. In many cases, this bribe was paid by large borrowers or corporate groups on behalf of the candidate concerned. In this case, there was a condition that after becoming the chairman-MD, the group that paid the money would be given the opportunity to withdraw a large amount of money as a loan from the bank. There used to be two or three influential directors on the board. The job of these directors, known as political leaders or Awami professionals, was to keep the board under control. If a large loan proposal was passed, they would also receive a part of this bribe. The responsibility of the directors appointed outside of lobbying was limited only to fulfilling the quorum of the board meeting. Honest directors had no opportunity to take a firm stand on any issue. More than lakhs of crores of taka have been embezzled from state-owned banks in the name of loans in this way.

According to Bangladesh Bank data, in September last year, the amount of defaulted loans of state-owned Sonali, Janata, Agrani, Rupali and Basic Bank was about 1 lakh 25 thousand crore taka. About 40 percent of the loans distributed by these banks were defaulted. However, the situation has worsened after September. By the end of December, the amount of defaulted loans of the banks exceeded 1.5 lakh crore taka. Apart from defaulting, at least another 50 thousand crore taka of loans are now overdue. Due to the impact of defaulted loans, the capital deficit of all five banks has become severe. If proper provisions are kept, all banks will face losses.

After the Awami League came to power in January 2009, the appointment of chairmen, directors and MDs in all state-owned banks was based on party considerations. Kazi Baharul Islam was appointed as the chairman of Sonali Bank, Abul Barkat as the chairman of Janata Bank, Khandaker Bazlul Haque as the chairman of Agrani Bank, Ahmed Al-Kabir as the chairman of Rupali Bank and Sheikh Abdul Hai Bachchu as the chairman of Basic Bank.

Party figures like Sirajganj Awami League leader Jannat Ara Henry, Cox’s Bazar’s Saimum Sarwar Kamal, Subhas Singha Roy, managing editor of Dainik Sangbad Kashem Humayun, former Chhatra League leaders Balram Poddar and Nagibul Islam Dipu, and Shahzada Mohiuddin were appointed as directors of the banks. At the same time, party-loyal MDs were appointed in all the state-owned banks. Immediately after these appointments made for political reasons, loan scandals broke out one after another in the state-owned banks.

Md. Obaid Ullah Al Masud was the managing director of the state-owned Sonali Bank for three years from August 2016 to 2019. In 2019, he was removed from Sonali Bank and appointed as MD of Rupali Bank for a three-year term. He is now serving as the chairman of the reconstituted board of Islami Bank Bangladesh PLC.

When asked about the appointment at that time, Obaid Ullah Al Masud told the media, “I was offered a bribe of Tk 100 crore to get reappointed as MD of Sonali Bank. I was told that I would not have to pay even Tk 1. Someone else would pay this money on my behalf. Later, the group would have to make unethical concessions. But because I did not agree to this offer, I was removed from Sonali and sent as MD of Rupali Bank despite my good performance.”

He said, “I have served as MD of two banks. I did not let S Alam or Salman F Rahman take any unethical benefits from any bank. That is why they were unhappy with me.”

Salman F Rahman himself took advantage of Sheikh Rehana’s role in appointing the chairmen and MDs of state-owned banks. His Beximco Group has borrowed around Tk 35,000 crore from four major state-owned banks alone. Out of this, Beximco’s debt has now reached Tk 26,000 crore from Janata Bank alone.

Sheikh Rehana lives in a house in Golders Green, North London. According to documents, the owner of the house is Ahmed Shayan Fazlur Rahman, son of Salman F Rahman. After the fall of Sheikh Hasina, Shayan Rahman’s bank accounts along with others were frozen by the Bangladesh Financial Intelligence Unit (BFIU). He has also been removed from the board of private sector IFIC Bank. And

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button